সাপ Animalia রাজ্যের Chordata পর্বের Reptilia শ্রেণীর Serpents বর্গের অন্তর্ভুক্ত লম্বা বেলনাকার পা-হীন, শীতল-রক্তের(Cold-blooded) মেরুদন্ডী (Vertebrates) প্রাণী। যেহেতু তারা শীতল-রক্তের প্রাণী তাই এদের আশেপাশের পরিবেশ থেকে(যেমন সূর্যের আলো) শরীর উষ্ণ করতে হয়(Ectothermic)। এরা যৌন দ্বিরূপী (Sexually dimorphic) এবং এদের কোন বহিঃকর্ণ নেই, সেজন্য বায়ুবাহিত শব্দ নিখুঁতভাবে গ্রহন করতে পারে না। তবে মাটি বা অন্য যে মাধ্যমে এরা থাকে তা থেকে শব্দ তরঙ্গ নিচের চোয়াল ও কোয়াড্রট অস্থির মাধ্যমে অন্তঃকর্ণ গ্রহণ করতে পারে। এরা সাধারনত নিশাচর (Nocturnal) প্রাণী এবং বছরে কয়েকবার খোলস বদলায় (Sloughing)। এদের চোখে পাতা (Eyelids) নেই এবং এরা জিভ (Forked tongues) দিয়ে শিকারের ঘ্রাণ নেয়। এদের কশেরুকার (Vertebrae) সংখ্যা ১০০ থেকে ৪০০ পর্যন্ত হতে পারে। সাপ প্রধানত মাংসাশী (Carnivorous) এবং কিছু সাপ স্বগোএভোজী (Cannibal)। এই গ্রহের বেশির ভাগ সাপ ডিম পারে (Oviparous), আবার কিছু সাপ ডিম না পেরে বাচ্চা জন্ম (Viviparous) দেয়। একমাত্র এন্টার্টিকা (Antarctica) মহাদেশ ব্যতীত পৃথিবীর সব কটি মহাদেশে (Continents) সাপ বাস করে। আমাজনে (Amazon) বাস করে সবচেয়ে বড় (Heaviest) সাপ Green anaconda (Eunectes murinus) এবং ক্যারিবিয়ান (Caribbean) দীপপুঞ্জের বার্বাডোসে (Barbados) পাওয়া যায় সবচেয়ে ছোট সাপ Barbados threadsnake (Leptotyphlops carlae)। পক্ষান্তরে, অস্ট্রেলীয়ায় বাস করে এই গ্রহের স্থলের মধ্যে সবচেয়ে বিষধর সাপ Inland Taipan (Oxyuranus microlepidotus). সামুদ্রিক সাপ Hydrophidae আরো বিষধর, যেমন Belcher's sea snake (Hydrophis belcheri) অনেকের মতে এই গ্রহের সবচেয়ে বিষধর সাপ। আফ্রিকায় (Africa) বাস করে সবচেয়ে রাগান্বিত/আক্রমণাত্মক (Aggressive) এবং দ্রুত গতির (Fastest) সাপ Black mamba (Dendroaspis polylepis)। আশ্চর্যজনক ভাবে বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম বিষধর সাপ King Cobra (Ophiophagus hannah) শংঙ্খচূড় এবং দীর্ঘতম (Longest) সাপ Reticulated python (python reticulatus) জালি অজগর, গোলবাহার পাওয়া যায়। সাপ মারা ঠিক নয় কারন এরা আমাদের বাস্তুসংস্থানে (Ecology) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটা সহজেই অনুমেয় যে ইঁদুর আমাদের সাপের থেকে অনেক বেশি ক্ষতি করে আর সাপ হচ্ছে প্রাকৃতিক ইঁদুর(Natural pesticides) দমনকারী। সম্ভব হলে বাড়ির আশেপাশে সাপ দমনকারী প্রাণীর(বেজি,গুইসাপ,পাখি) আবাসস্থল গড়ে তুলতে সাহায্য করা অথবা বাড়িতে কুকুর,বেড়াল পোষা। বাড়িতে সাপের উপদ্রব বেড়ে গেলে কার্বোলিক এসিড (Carbolic acid) প্রয়োগ করা যেতে পারে। শীতকালে সাপ শীতযাপন (Hybernate) করে তাই গরম কালে এদের দেখা মেলে, এ সময়টা একটু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বিশেষ করে রাতের বেলায় যেহেতু ওরা নিশাচর (Nocturnal) প্রাণী। তাই রাতের বেলায় অবশ্যই বাতি সঙ্গে রাখা,নির্জন জায়গায় শব্দ করে হাটা বা কাজ করা এবং পায়ে জুতো পরে কর্মে যাওয়া উচিত। সাপ কে কখনো উত্যক্ত না করা অথবা খেলা না করা।
সাপের বিষ (Snake's venom) এক ধরনের জটিল জৈব যৌগ বা অতি রূপান্তরিত লালা (Highly modified saliva), যা নিঃসৃত হয় সাপের মুখের এক বিশেষ গ্রন্থি (Venom gland) থেকে। সাধারনত বিষাক্ত সাপের মুখের সামনের দিকে দুই পাশে দুটি বড় বিষদাঁত (Fang) থাকে, যা বিষগ্রন্থির (Venom gland) সঙ্গে যুক্ত। বিষদাঁতের সাহায্যেই সাপ তার বিষগ্রন্থির নিঃসৃত রস শিকারের দেহে প্রবিষ্ট করে এবং বিষক্রিয়া (Envenom) ঘটায়। সাপের বিষ মূলত জৈব রাসায়নিকভাবে প্রোটিন, পলিপেপটাইড এবং অপ্রোটিন (জৈব ও অজৈব) উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। সাপের বিষ ২০ টির ও বেশি উপাদানে (যেমন, Proteases,Nucleases,Phosphodiesterases,Enzymes) গঠিত এবং বিষের প্রায় ৯০% প্রোটিন ও পলিপেপটাইড এবং এসব যৌগই বিষক্রিয়ার(Intoxication) জন্য দায়ী। এদের বিষের এনজাইম (Enzymes) তাদের শিকার হজম করবার জন্য বিশেষ গুরুত্ব রাখে। বিষধর সাপেরা সাধারনত নিউরোটক্সিন (Neurotoxins), হিমোটক্সিন (Hemotoxins), সাইটোক্সিন (Cytotoxins), কার্ডিওটক্সিন (Cardiotoxins), মাইওটক্সিন (Myotoxins) বিষ দ্বারা সমৃদ্ধ। Charles Lucien Bonaparte, ১৮৪৩ সালে প্রথম প্রোটিন-সমৃদ্ধ (Proteinaceous) বিষের কথা উল্লেখ করেন।
 |
বিষ দাঁত হতে বিষ বের হচ্ছে |
বিষ-প্রতিষেধক (Antivenom /Antivenin)
 |
লিওন চার্লিস আলবার্ট কালমিট সাপের বিষ-প্রতিষেধক এর উদ্ভাবক |
সাপের বিষ সাধারনত কোন ঘোড়া বা ভেড়ার দেহে অল্প পরিমাণ (Non-lethal doses) প্রবেশ করিয়ে, প্রাণী টিকে উচ্চ বিষ-প্রতিরোধ্য (Hyperimmunized) করবার জন্য সেটির শরীরে ধীরে ধীরে Antibody তৈরি করে। পরবর্তীতে প্রাণীটির শরীর থেকে রক্ত বের করে সেই রক্ত থেকে বিশুদ্ধ (Purified) Antibody বের করে বিষপ্রতিষেধক (Antivenom) তৈরি করা হয়। তাই বলা যায় যে সাপের বিষের প্রতিষেধক তৈরি করতে সেই সাপের বিষ প্রয়োজন। আলবার্ট কালমিট (Albert calmette) যিনি একজন ফ্রান্সের ডাক্তার(Physician), জীবাণু-বিশারদ(Bacteriologist) এবং রোগের অণাক্রম্যতা-বিশারদ(Immunologist), তিনি ১৮৯৫ সালে প্রথম সাপের বিষ-প্রতিষেধক(Antivenin) আবিষ্কার করেন তাই তাঁর স্মরণে এটাকে Calmette's serum ও বলা হয়। বিষপ্রতিষেধক দুপ্রকারের Monovalent antivenom যা নির্দিষ্ট প্রজাতির সাপের বিষের জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি কার্যকরী এবং Polyvalent antivenom যা দুই বা ততোধিক প্রজাতির সাপের বিষের জন্য অপেক্ষাকৃত কম কার্যকরী। কিছু প্রাণী আছে যারা সাপের বিষের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত, যেমন বেজি (Mongoose), শজারু (Hedgehog), Honeybadger, Meerkat ইত্যাদি। আমাদের দেশের বেজি প্রকৃতিগত ভাবে Cobra/গোখরার বিষে অনাক্রম্য (Immune)। মানুষের মধ্যে অনেকে আবার সাপের বিষের অনাক্রম্যতা (Immunity) লাভ করে যেমন,মিথ্রিডেটিজম (Mithridatism) এর মাধ্যমে।
Mithridatism শব্দটি এসেছে Mithridates VI, যিনি Pontus এর রাজা ছিলেন, তিনি ভাবতেন তাঁকে ও তাঁর বাবার মতো বিষ-প্রয়োগ করে মেরে ফেলা হতে পারে, তাই তিনি তাঁর শরীরে নিয়মিত অল্প পরিমাণ (Non-lethal doses) প্রবেশ করাতেন এই প্রত্যাশায় যে তাঁর শরীর ধীরে ধীরে বিষ প্রতিরোধী (Immunized) হয়ে উঠবে। পরবর্তীকালে Bill Haast যিনি Miami Serpentarium এর মালিক এবং পরিচালক তিনিও তার যৌবন বয়সে নিয়মিত অল্প পরিমাণ সাপের বিষ তার শরীরে প্রবেশ করাতেন তার শরীর কে বিষ-প্রতিরোধ্য করবার আশায়। তিনি প্রায় ১০০ বছর বেঁচে ছিলেন এবং ১৭২ বার সাপের কামড় খেয়েছিলেন। তিনি তার রক্ত সাপে কামড়ানোর চিকিৎসার জন্য দান করেন এবং প্রায় ২০ জন রোগী তা হতে মুক্তি লাভ করে। আমাদের দেশের বিষ-প্রতিষেধক প্রধানত ইন্ডিয়ার উপর নির্ভরশীল। একমাত্র Incepta Pharmaceuticals প্রথমবারের মতো আমাদের দেশে Antivenom (Antivenin) উৎপাদন শুরু করে।
 |
বিষ-প্রতিষেধক উৎপাদনের জন্য সাপ থেকে বিষ সংগ্রহ করা হচ্ছে |
 |
আমাদের দেশের প্রথম বিষ-প্রতিষেধক |
দংশন এবং চিকিৎসা(Snake bite & treatment)
বিষধর সাপের কামড় একটি মারাত্মক সমস্যা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক চিকিৎসার অভাবে আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। আধুনিক চিকিৎসার অভাব এবং আমাদের দেশের মানুষের অজ্ঞতার কারনে মৃত্যুহার বেশি। আবার আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতালে এর চিকিৎসা প্রায় হয়না বললেই চলে কারন দক্ষ চিকিৎসক (সাপ সনাক্ত করতে না পারায় রোগী ফিরিয়ে দেয়া) এর অভাব অথবা বিষ-প্রতিষেধকের অভাব। তাই আক্রান্ত ব্যক্তিকে খানিক টা বাধ্য কিংবা নিরুপায় হয়ে ওঝা (Healer) ডেকে চিকিৎসা নেয়া হয়। কিন্তুু একটু সচেতন হলে এর সঠিক চিকিৎসা সম্ভব। তাই আধুনিক বিশ্বে মৃত্যুহার অনেক কম। প্রথমত বিষধর সাপ চেনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক এর চিকিৎসা করা টা সহজ হয়ে যায়। বিষধর সাপের কামড়ের উল্লেখযোগ্য উপসর্গ (Symptoms) গুলো হলো এক জোড়া দাঁতের চিহ্ন (Two punctures wound / Fang mark), দংশনেরর স্থান ফুলে যাওয়া (Swelling), কামড়ানোর স্থান হতে অবিরত রক্ত বের হওয়া (Prolonged bleeding), প্রস্রাব বন্ধ হওয়া (Renal failure), নিম্ন-রক্তচাপ (Hypotension), দেহ অসাড় করা/ পক্ষাঘাত (Numbness / Paralysis), চোখের পাতা ভারী হয়ে বুজে আসা (Ptosis), চোখ অসাড় করা (Ophthaloplegia), চোখে ঝাপসা দেখা (Blurred vision), দংশনের স্থান কালচে পড়া অথবা ফোসকা পড়া অথবা পচন ধরা (Necrosis), মুখের মাড়ি হতে রক্ত ঝরা (Gum's bleeding), বমি করা (Vomiting), নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া (Difficulty breathing), ঘামা বা মুখ দিয়ে লালা বের হওয়া (Sweating / Salivating), তীব্র যন্ত্রণা হওয়া (Severe pain), মাথা ঘোরা বা বমি বমি ভাব (Nauseating), মূর্ছা যাওয়া(fainting) ইত্যাদি। এক এক ধরনের বিষে এক এক ধরনের উপসর্গ, যেমন Krait (কেউটে) এর কামড়ে তীব্র যন্ত্রণা নাও হতে পারে।
 |
Neurotoxin এবং Haemotoxin বিষের লক্ষণ সমূহ |
 |
ফোসকা বা কালচে পড়া (Necrosis) |
 |
এক জোড়া দাঁতের চিহ্ন (Two punctures wound) |
 |
চোখের পাতা ভারী হয়ে বুজে আসা (Ptosis) |
 |
সাপে কামড়ানোর সাধারন উপসর্গ |
লক্ষণসমূহ দেখে বিষধর সাপের কামড় মনে হলে যা করতে হবে, আক্রান্ত স্থান নাড়াচাড়া না করা, কামড়ের পড়ে দৌড়ান যাবে না, কামড়ের স্থান পরিষ্কার করা এবং Antibiotic প্রয়োগ করা, কামড়ের স্থান হতে একটু উপরে হালকা করে বাঁধা(Tourniquet) যাতে বিষ ধীর গতিতে ছড়ায় কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়(অনেকের মতে এটা অপ্রয়োজনীয়), রোগীকে সাহস যোগানো কারন বিষধর সাপে কামড়ালে যে নিশ্চিত মৃত্যু এমন সম্ভাবনা শতভাগ নয় (সাপটি কামড়ানোর সময় পর্যাপ্ত বিষ (Fatal dose) না ঢুকাতে পারে)। সবচেয়ে দরকারি হচ্ছে রোগীকে সম্পূর্ণ কোলাহল মুক্ত পরিবেশে রাখতে হবে যাতে তার শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সমস্যা না হয় প্রয়োজন হলে তাকে কৃএিম ভাবে শ্বাস/অক্সিজেন (Artificial respiratory support) দেয়া, কারন অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগী হাসপাতালে আসার পূর্বে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া অচল হয়ে (Respiratory paralysis/failure) মৃত্যুবরণ করে। সবশেষে রোগীকে যতো দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে অথবা চিকিৎসক এর মাধ্যমে বিষ-প্রতিষেধক প্রয়োগ করা। এ কাজ টি যত দ্রুত করা যায় ততোই মঙ্গল কারন সাপের বিষ-প্রতিষেধক শুধুমাত্র শরীরের মধ্যে সাপের বিষ কে নিষ্ক্রিয় করে কিন্তুু বিষের ক্রিয়ার ফলে শরীরের যে ক্ষতি (ক্ষেত্রবিশেষে অঙ্গহানি) হয় তা সারাতে পারে না। নিচে একটি Indian polyvalent antivenom দেখানো হলো যেটা চারটি বিষধর সাপের কামড়ের জন্য ব্যবহার করা হয়।

অনেক কিছু জানতে পারলাম
ReplyDeleteপ্রবন্ধ টি পড়ে খুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteBy reading this I have learnt a lot of things about venomous snakes bite.
ReplyDeleteআপনার সবকটি পোষ্ট মুগ্ধক। "এটা তার মধ্যে অন্যতম"।
ReplyDeleteলেখাটি পড়ে অনেক কিছু জানা গেল।
ReplyDelete