সুন্দরবন (Sundarbans)
সুন্দরবন বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী প্রশস্ত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং ইন্ডিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি ছোট্ট অঞ্চলের প্রাকৃতিক বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রক্ষপুত্র নদীএয়ের অববাহিকায় ব-দ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এবং পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার সামান্য অংশ জুড়ে বিস্তৃত, সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশে এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপীয় (Deltaic) অঞ্চলের (গঙ্গা বা পদ্মা,বক্ষ্রপুত্র,মেঘনা) সর্ববৃহৎ অখন্ড ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল (যে বনভূমিতে ম্যানগ্রোভ গাছের প্রাধান্য বেশি সেই বনাঞ্চল কে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল বলে)। সাধারনত এসব বনাঞ্চল সমুদ্র উপকূলবর্তী জলাকীর্ণ অঞ্চলে হয়ে থাকে। আর ম্যানগ্রোভ গাছগাছালি এসব জলাকীর্ণ অঞ্চলের জন্য বিশেষ উপযোগী কারন এদের শ্বাসমূল(Pneumatophores) পানির নিচ থেকে উপরে উঠে তাদের শ্বাসকার্য(Gaseous exchange) সম্পন্ন করে (যেমন সুন্দরি গাছ), বিশেষ করে বৃষ্টির মৌসুমে যখন এ বনাঞ্চলের প্রায় সমস্ত জায়গা জলাবদ্ধ থাকে।
প্রায় ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের প্রায় ৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে বাকি অংশ পাশ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়ার দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগুনা জেলায় অবস্থিত। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং ১৯৯২ সালে রামসার (Ramsar Convention হলো বিশ্বব্যাপী জৈবপরিবেশ রক্ষার একটি সম্মিলিত প্রয়াস যাতে ১৫৮ টি দেশ স্বাক্ষর করেছে এবং এই পৃথিবীর ১৬৯ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা জুড়ে ১,৮২৮ টি স্থান কে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়) স্থান হিসেবে ভূষিত হয়।
এ বনকে ৫ টি অভয়ারণ্যে(Sanctuary) ভাগ করা হয়েছে, এর মধ্যে সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান/Sundarbans national park ও সাজনাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য/Sajnakhali wild-life sanctuary ইন্ডিয়াতে এবং সুন্দরবন পূর্ব বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য/Sundarbans east wild-life sanctuary, সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য/Sundarbans south wild-life sanctuary ও সুন্দরবন পশ্চিম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য/Sundarbans west wild-life sanctuary বাংলাদেশে। প্রধানত লবণাক্তার ভিত্তিতে আমাদের দেশের সুন্দরবন কে এই তিনটি অভয়ারণ্যে ভাগ করা হয়েছে এর মধ্যে পূর্ব বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বাগেরহাট জেলার তিনটি থানায় (মংলা,মোরলগঞ্জ,শরণখোলা) অবস্থিত এবং এখানকার পানি তুলনামূলক ভাবে মিষ্টি(Fresh-water) / সামান্য লবনাক্ত(Slightly saline)। তাই এই অভয়ারণ্যেকে মিঠা পানির জঙ্গলও বলে। এখানকার মিঠা পনির প্রধান উৎস বলেশ্বর নদ এবং এখানে সুন্দরি>গেওয়া>পশুর>কংক্রা>গরাণ>গোলপাতা গাছের প্রাধান্য বেশি। আবার দক্ষিণ অভয়ারণ্যের পানি তুলনামূলক ভাবে কম লবণাক্ত(Moderately Salt-water) তাই একে কম লবণাক্ত পানির জঙ্গলও বলে এবং এটা খুলনা জেলার দুটি থানায় (কয়রা,দাকোপ) অবস্থিত। এখানকার উদ্ভিদ এর মধ্যে গেওয়া>সুন্দরি>গরাণ>পশুর>কংক্রা> বাইন> গোলপাতা গাছের প্রাধান্য বেশি। অন্যদিকে পশ্চিম অভয়ারণ্যের পানি অপেক্ষাকৃত বেশি লবনাক্ত(Salt-water) তাই একে লবনাক্ত পানির জঙ্গলও বলে। এটা সাতক্ষীরা জেলার একটি থানায় (শ্যামনগর) অবস্থিত, এখানকার পানির প্রধান উৎস মালঞ্চ নদী এবং উদ্ভিদ জগৎতের মধ্যে গরাণ>গেওয়া>হন্তাল>ধুন্দল>পশুর> কংক্রা গাছের প্রাধান্য বেশি।
সুন্দরবন কে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, অসংখ্য নদী, কাদার চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততা সহ ছোট ছোট দ্বীপমালা। মোট বনভূমির প্রায় ৩০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে নদী(Rivers),শাখানদী(Tributaries), খাল (Canals),খাঁড়ি(Creeks),বিল(Swamps) মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। এসব জলাভূমি সহ সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১৪,৬০০ বর্গ কিলোমিটার এবং এসব নদী-নালা, খাঁড়ি গুলো এমন ভাবে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত যে জোয়ারের সময় ছোট নৌকায় করে এ বনের প্রায় সব প্রান্তে যাওয়া যায়। আমাদের দেশের এ বনটির পূর্বে রয়েছে বলেশ্বর,শেলা গাং,পশুর,শিবসা,কুঙ্গা,অপর্ণগাছিয়া নদী আর পশ্চিমে রয়েছে মালঞ্চ,যমুনা,রায়মঙ্গল,হরিনভাঙ্গা নদী এবং দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর।
বনভূমি টি স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার (Bengal tiger-Panthera tigris tigris) এর জন্য এবং এখানে এদের প্রধান শিকার চিত্রা হরিন (Spotted deer-Axis axis) যা এখানে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায় আর এই হরিনের প্রিয় খাদ্য এ বনের কেওড়া গাছের পাতা। তাছাড়া এখানে নোনা পানির কুমির (Solt-water crocodile-Crocodylus porosus), বন্য শুকর (Wild boar-Sus scrofa),বিভিন্ন প্রজাতির পাখী ও সাপ সহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। অনেকের মতে সুন্দরী (Heritiera fomes) গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে যা এখানে প্রচুর পরিমাণ জন্মায়। আবার সমুদ্র-বন থেকে এ বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন, বলে অনেকে মত দেন। তবে প্রথম মত টি বহুল প্রচলিত মত। সুন্দরবনের নদীগুলো নোনা পানি (Solt-water) ও মিঠা পানির (Fresh-water) মিলন স্থান। সুতরাং প্রধানত গঙ্গা থেকে আসা নদীর মিঠা পানির, বঙ্গোপসাগরের নোনা পানি হয়ে ওঠার মধ্যবর্তী স্থান হলো এ এলাকাটি। হাজার হাজার বছর ধরে বঙ্গোপসাগর বরাবর আন্তঃস্রোতীয় প্রবাহের দরুন প্রাকৃতিকভাবে উপরিস্রোত থেকে পৃথক হওয়া পলি সঞ্চিত হয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। এছাড়া বৃষ্টির মৌসুমে গঙ্গা ও বক্ষ্রপুত্র হতে বিশাল পরিমানে পলি নিয়ে আসা মিঠা পানি (যা প্রধানত হিমালয় ও মেঘালয় পর্বতশ্রেণী থেকে আসে), সুন্দরবনের লবণাক্ত পানিকে ঠেলে বঙ্গোপসাগরের দিকে দেয় এবং পলি সঞ্চয়(Siltation) করে এবং এখানে প্রতি ২৪ ঘন্টায় ২ বার জোয়ার(Flow-tide) ও ২ বার ভাটা(Ebb-tide) হয় যা পলি সঞ্চয় করে নদী তলের উচ্চতা বৃদ্ধি করে নতুন নতুন দ্বীপ(Islands) সৃষ্টি করে। এই জোয়ার-ভাটা এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আর সেটা হলো এখানকার উদ্ভিদজগৎতের ফল বা বীজ কে অন্যত্র ভাসিয়ে নিয়ে যায় খুব সহজেই এবং এভাবেই এরা এখানে বংশবৃদ্ধি করে থাকে।
এই প্রাকৃতিক লীলাভূমির ভৌগলিক গঠন ব-দ্বীপীয়, যার উপরিতলে রয়েছে অসংখ্য জলধারা এবং জলতরে ছড়িয়ে আছে মাটির দেয়াল(Mud walls) ও কাদা-চর(Mudflats)। এতে আরো রয়েছে সমুদ্র সমতলের গড় উচ্চতার চেয়ে উঁচুতে থাকা প্রান্তীয় তৃণভূমি, বালুতট(Sandbars) এবং দ্বীপ, যেগুলো জুড়ে জালের মতো জড়িয়ে আছে খাল, জলতলের মাটির দেয়াল, আদি ব-দ্বীপীয় কাদা ও সঞ্চিত পলি। সমুদ্র সমতল থেকে সুন্দরবনের উচ্চতা স্থানভেদে ০.৮ মিটার থেকে ২.৫ মিটার। গড়ে এ বনের তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং সর্বোচ্চ ৪৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং বাতাসের আদ্রতা ৮০%। এ বনের বাস্তুসংস্থান (Ecology) যথেষ্ট জটিল। সামুদ্রিক বিষয়ের গঠন প্রক্রিয়া,উদ্ভিদ বৈচিত্র্য(Floral diversity) ও প্রাণী বৈচিত্র্যের(Faunal diversity) ক্ষেত্রে এখানকার জৈবিক উপাদান গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সৈকত(Beaches), মোহনা (Estuaries), স্থায়ী ও অস্থায়ী জলাভূমি(Permanent /Temporary swamps), কাদা-চর(Mudflats), খাঁড়ি(Creeks), বালিয়াড়ি(Sand dune), মাটির স্তুপের মতো বৈচিত্র্যময় অংশ গঠিত হয়েছে এখানে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ জগৎ নিজেই নতুন ভূমি গঠনে ভূমিকা রাখে। আবার আন্তঃস্রোতীয় উদ্ভিদ জগৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জলে অঙ্গসংস্থান প্রক্রিয়ায়।
ম্যানগ্রোভ প্রাণীজগৎ এর উপস্থিতি আন্তঃস্রোতীয় কাদা-চরে ব্যাষ্টিক অঙ্গসংস্থানিক পরিবেশে তৈরি করে। এটি পলিকে ধরে রাখে বীজের জন্য আনুভূমিক উপ-শিলাস্তর সৃষ্টির জন্য। অনন্ত বালিয়াড়ির সংগঠন ও বিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় প্রচুর পরিমানে থাকা Xerophytic ও Halophytic গাছ দ্বারা। এ কারনে এ বনকে Halophytic mangrove ও বলা হয়। লতা-পাতা, ঘাস-হোগলা বালিয়াড়ি ও অসংগঠিত পলিস্তরের গঠন কে স্থিতিশীল করে। উপকূল বরাবর সুন্দরবনের গঠন প্রকৃতি বহুমাত্রিক উপাদান সমূহ দ্বারা প্রভাবিত, যাদের মধ্যে রয়েছে স্রোতের গতি, ব্যাষ্টিক ও সমষ্টিক স্রোত চক্র এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী দীর্ঘ সমুদ্রতটের স্রোত। বিভিন্ন মৌসুমে সমুদ্রতটের স্রোত যথেষ্ট পরিবর্তনশীল এরা ঘূর্ণিঝড়ের কারনেও পরিবর্তিত হয়। এসবের মধ্যে যে ক্ষয় ও সঞ্চয় হয়, তা ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনে মাত্রাগত পার্থক্য তৈরি করে। অবশ্য ম্যানগ্রোভ বনটি নিজেই এর পুরো ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। বনভূমির পাশাপাশি সুন্দরবনের বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে নোনতা ও মিঠা পানির জলাধার, আন্তঃস্রোতীয় পলিভূমি, বালুচর, বালিয়াড়ি, বেলেমাটিতে উম্মুক্ত তৃণভূমি এবং গাছ ও গুল্মের এলাকা।
![]() |
ম্যানগ্রোভ গাছের শ্বাসমূল পানির নিচ থেকে উপরে উঠে |
![]() |
নদী পাড়ের ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছের শ্বাসমূল |

![]() |
জীবিকানির্বাহের প্রয়োজনে সুন্দরবনে |
সুন্দরবন কে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, অসংখ্য নদী, কাদার চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততা সহ ছোট ছোট দ্বীপমালা। মোট বনভূমির প্রায় ৩০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে নদী(Rivers),শাখানদী(Tributaries), খাল (Canals),খাঁড়ি(Creeks),বিল(Swamps) মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। এসব জলাভূমি সহ সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১৪,৬০০ বর্গ কিলোমিটার এবং এসব নদী-নালা, খাঁড়ি গুলো এমন ভাবে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত যে জোয়ারের সময় ছোট নৌকায় করে এ বনের প্রায় সব প্রান্তে যাওয়া যায়। আমাদের দেশের এ বনটির পূর্বে রয়েছে বলেশ্বর,শেলা গাং,পশুর,শিবসা,কুঙ্গা,অপর্ণগাছিয়া নদী আর পশ্চিমে রয়েছে মালঞ্চ,যমুনা,রায়মঙ্গল,হরিনভাঙ্গা নদী এবং দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর।
![]() |
সুন্দরবনকে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে নদী-নালা |
![]() |
সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার |
বনভূমি টি স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার (Bengal tiger-Panthera tigris tigris) এর জন্য এবং এখানে এদের প্রধান শিকার চিত্রা হরিন (Spotted deer-Axis axis) যা এখানে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায় আর এই হরিনের প্রিয় খাদ্য এ বনের কেওড়া গাছের পাতা। তাছাড়া এখানে নোনা পানির কুমির (Solt-water crocodile-Crocodylus porosus), বন্য শুকর (Wild boar-Sus scrofa),বিভিন্ন প্রজাতির পাখী ও সাপ সহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। অনেকের মতে সুন্দরী (Heritiera fomes) গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে যা এখানে প্রচুর পরিমাণ জন্মায়। আবার সমুদ্র-বন থেকে এ বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন, বলে অনেকে মত দেন। তবে প্রথম মত টি বহুল প্রচলিত মত। সুন্দরবনের নদীগুলো নোনা পানি (Solt-water) ও মিঠা পানির (Fresh-water) মিলন স্থান। সুতরাং প্রধানত গঙ্গা থেকে আসা নদীর মিঠা পানির, বঙ্গোপসাগরের নোনা পানি হয়ে ওঠার মধ্যবর্তী স্থান হলো এ এলাকাটি। হাজার হাজার বছর ধরে বঙ্গোপসাগর বরাবর আন্তঃস্রোতীয় প্রবাহের দরুন প্রাকৃতিকভাবে উপরিস্রোত থেকে পৃথক হওয়া পলি সঞ্চিত হয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। এছাড়া বৃষ্টির মৌসুমে গঙ্গা ও বক্ষ্রপুত্র হতে বিশাল পরিমানে পলি নিয়ে আসা মিঠা পানি (যা প্রধানত হিমালয় ও মেঘালয় পর্বতশ্রেণী থেকে আসে), সুন্দরবনের লবণাক্ত পানিকে ঠেলে বঙ্গোপসাগরের দিকে দেয় এবং পলি সঞ্চয়(Siltation) করে এবং এখানে প্রতি ২৪ ঘন্টায় ২ বার জোয়ার(Flow-tide) ও ২ বার ভাটা(Ebb-tide) হয় যা পলি সঞ্চয় করে নদী তলের উচ্চতা বৃদ্ধি করে নতুন নতুন দ্বীপ(Islands) সৃষ্টি করে। এই জোয়ার-ভাটা এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আর সেটা হলো এখানকার উদ্ভিদজগৎতের ফল বা বীজ কে অন্যত্র ভাসিয়ে নিয়ে যায় খুব সহজেই এবং এভাবেই এরা এখানে বংশবৃদ্ধি করে থাকে।
![]() |
সুন্দরবনের গোলপাতা গাছ |
![]() |
সুন্দরবনের ঘন জঙ্গল |
এই প্রাকৃতিক লীলাভূমির ভৌগলিক গঠন ব-দ্বীপীয়, যার উপরিতলে রয়েছে অসংখ্য জলধারা এবং জলতরে ছড়িয়ে আছে মাটির দেয়াল(Mud walls) ও কাদা-চর(Mudflats)। এতে আরো রয়েছে সমুদ্র সমতলের গড় উচ্চতার চেয়ে উঁচুতে থাকা প্রান্তীয় তৃণভূমি, বালুতট(Sandbars) এবং দ্বীপ, যেগুলো জুড়ে জালের মতো জড়িয়ে আছে খাল, জলতলের মাটির দেয়াল, আদি ব-দ্বীপীয় কাদা ও সঞ্চিত পলি। সমুদ্র সমতল থেকে সুন্দরবনের উচ্চতা স্থানভেদে ০.৮ মিটার থেকে ২.৫ মিটার। গড়ে এ বনের তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং সর্বোচ্চ ৪৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং বাতাসের আদ্রতা ৮০%। এ বনের বাস্তুসংস্থান (Ecology) যথেষ্ট জটিল। সামুদ্রিক বিষয়ের গঠন প্রক্রিয়া,উদ্ভিদ বৈচিত্র্য(Floral diversity) ও প্রাণী বৈচিত্র্যের(Faunal diversity) ক্ষেত্রে এখানকার জৈবিক উপাদান গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সৈকত(Beaches), মোহনা (Estuaries), স্থায়ী ও অস্থায়ী জলাভূমি(Permanent /Temporary swamps), কাদা-চর(Mudflats), খাঁড়ি(Creeks), বালিয়াড়ি(Sand dune), মাটির স্তুপের মতো বৈচিত্র্যময় অংশ গঠিত হয়েছে এখানে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ জগৎ নিজেই নতুন ভূমি গঠনে ভূমিকা রাখে। আবার আন্তঃস্রোতীয় উদ্ভিদ জগৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জলে অঙ্গসংস্থান প্রক্রিয়ায়।
![]() |
নতুন চারা গাছ জন্মাচ্ছে |
![]() |
কাদার-চর |
![]() |
জোয়ার-ভাটার সুন্দরবনের শ্বাসমূল |



সুন্দরবনের উদ্ভিদজগৎ (Flora of Sundarbans)
পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের বেশির ভাগ ম্যানগ্রোভে Rhizophoraceae, Avicenneaceae বা Laganculariaceae শ্রেণীর গাছের প্রাধান্য থাকলে বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভে প্রাধান্য Sterculiaceae এবং Euphorbiaceae শ্রেণীর গাছের। সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩৩৪ প্রজাতির গাছ। প্রাকৃতিক ভাবে এখানে প্রচুর পরিমানে সুন্দরী(Heritiera fomes) গাছ জন্মায় এ বনে এবং এটি একটি বিশেষ ম্যানগ্রোভ গাছ যাদের শ্বাসমূল পানির নিচ থেকে উপরে উঠে উদ্ভিদটির শ্বাসকার্য পরিচালনা করতে সাহায্য করে। তাছাড়া এ বনে আরো রয়েছে গেওয়া(Excoecaria agallocha), গরাণ(Ceriops decandra), কেওড়া(Sonneratia apetala), গোলপাতা(Nypa fruticans), ধুন্দল(Xylocarpus granatum), পশুর(Xylocarpus mekongensis), বাইন (Avicennia officinalis), সাদা-বাইন(Avice nnia alba), হন্তাল(Phoenix paludosa), আমুর(Amoora cucullata), সিংড়া(Cynometra ramiflora), গর্জন(Rhizophora mucronata), গাব(Diospyrus peregrina), করঞ্জা(Pongamia globra), বনজাম(Syzygium fruticosum), কুল(Zizyphus Mauritiana), ওড়া(Sonneratia caseolaris), ঘাস ও গুল্মর মধ্যে (Poresia coaractata,Myriostachya, Wightiana), শণ (Imperata cylindrical), উলু (Phragmites karka), নল (Orundo karka), হোগলা (Typa elephantina), হুডো(Acrostichum aureum), হারগোজা (Acanthus ilicifolius), সুন্দরি লতা(Brownlowia tersa), খালিশা(Aegiceras corniculatum), উল্লেখযোগ্য। এ বন যেমন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জাতীয় অর্থনীতিতে। এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস। এই বন কাঠের উপর নির্ভরশীল শিল্পে কাঁচামাল জোগান দেয়। এছাড়া কাঠ, জ্বালানী ও মন্ডের মত প্রথাগত বনজ সম্পদের পাশাপাশি এ বন থেকে নিয়মিত ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয় ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি এবং শামুক-ঝিনুক।
বৃক্ষপূর্ণ সুন্দবনের এই ভূমি একই সাথে বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল, অক্সিজেন উৎপাদক, পুষ্টি উৎপাদক, পানি বিশুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড় প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী, শক্তি-সম্পদের আধার এবং একটি মনোরম পর্যটন কেন্দ্র। এই বন প্রচুর প্রতিরোধ-মূলক ও উৎপাদন-মূলক ভূমিকা পালন করে। অনেক গুলি শিল্প যেমন নিউজপ্রিন্ট, দেয়াশলাই, হার্ডবোর্ড, নৌকা, আসবাব-পত্র ইত্যাদি সুন্দরবন থেকে আহরিত কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল। কমপক্ষে ৫ লক্ষ উপকূলবর্তী জনসংখ্যার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমানে কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। উৎপাদনমুখী ভূমিকার পাশাপাশি সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জনসংখ্যার এবং তাদের সম্পদের প্রাকৃতিক নিরাপত্তা-বলয় হিসেবে ভূমিকা রাখে।
![]() |
মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ |
![]() |
জঙ্গলে ভোঁদর দিয়ে মাছ ধরা |
সুন্দরবনের প্রাণীজগৎ (Fauna of Sundarbans)
সুন্দরবনে ব্যাপক প্রাণী-বৈচিত্র্য বিদ্যমান। এখানে প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী(Mammals), ৪০ প্রজাতির সরীসৃপ(Reptiles), ৮ প্রজাতির উভচর(Amphibians), ২৭০ প্রজাতির পাখী, ১৫০ প্রজাতির সাদা মাছ (White-fishes), ১৪ প্রজাতির চিংড়ি (গলদা ও বাগদা), ১০ প্রজাতির কাঁকড়া, ১০ প্রজাতির ঝিনুক, এবং এখানকার বড় নদীগুলোতে ইরাবতী(Ganges dolphins-Platanista gangetica) পাওয়া যায়।
তাছাড়া কেটো কচ্ছপ (Betagur baska), সুন্দি কাছিম (Lissemys punctata), ধুম তরুণাস্থি কাছিম (Trionyx hurum), সোনালী গুইসাপ/Yellow monitor(Varanus flavescens), বড় গুইসাপ/Water monitor(Varanus salvator), নোনাপানির কুমিড়/Salt-water crocodile(Crocodylus porosus), গড়িয়াল/Gharial(Gavialis gangeticus), স্বাদুপানির কুমিড়/Mugger crocodile(Crocodylus palustris),
গন্ধগোকুল/Civet(Vivernicula indica)। বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও ব্যাঙ তার মধ্যে এ গ্রহের সবচেয়ে দীর্ঘতম সাপ-জালি অজগর/Reticuleted python এবং সবচেয়ে দীর্ঘতম বিষধর সাপ শংঙ্খচূড়/King-cobra পাওয়া যায়।
আর স্তন্যপায়ী প্রাণীরাজ্যের মধ্যে রয়েছে আমাদের দেশের জাতীয় প্রাণী এবং বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার/Royal Bengal tiger(Panthera tigris tigris) যার মানুষ-খেকোর কুখ্যাতিও রয়েছে। সাধারনত Big cats এর মধ্যে সবাই পানিকে এড়িয়ে চলে কিন্তুু এরা এখানে পানির সহিত যথেষ্ট মানানসই এবং দক্ষ সাতারু। তাছাড়া আরো আছে চিত্রা হরিন/Spotted deer(Axis axis), মায়া হরিন/Indian muntjacs(Muntiacus muntjak),
মেছো বিড়াল/Fishing cats(Prionailurus viverrinus), বন বিড়াল/Jungle cat(Felis chaus), গেছো বিড়াল/Leapard cats(Prionailurus bengalensis), বন্য শুকড়/Wild-boar(Sus scrofa),
বানর/Rhesus macaque(Macaca mulatta),
বনরুই/Indian pangolins(Manis crassicaudata), ভোঁদর/common otters(Lutra lutra), দেশী ধূসর বেজি/Indian grey mongooses(Herpestes edwardsii),
ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের অতি পরিচিত চিংড়ি মাছ/Mudskiper, তাছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও মাছ।
যেমন পাখিদের মধ্যে আছে, পাতি শিকরে / Shikra(Accipiter badius),ঝুঁটিয়াল গোদাশিকরে / Crested Goshawk (Accipiter trivirgatus),ছোট গুটিঈগল / Lesser spotted eagle(Aguila clanga),তামাটে ঈগল / Tawny eagle(Aguila heliaca),বড় গুটিঈগল / Greater spotted eagle(Aguila rupax),পশ্চিমা পানকাপাসি / Western marsh harrier(Circus aeruginosus),ধলা কাপাসি / Pallid harrier(Circus macrourus),কালোডানা চিল / Black-winged kite(Elanus caeruleus),বাংলার শকুন / White-rumped vulture(Gyps bengalensis),ধলাপেট সিন্ধুঈগল / White-bellied sea eagle(Haliacetus leucogaster), পালাসি কুরাঈগল /Phallas fishing eagle(Haliacetus leucoryphus),মেটেমাথা কুরাঈগল / Grey-headed fishing eagle(Ichthyophaga ichthyaetus),শঙ্খ চিল / Brahminy kite(Haliastur indus),ভুবন চিল / Black kite(Milvus migrans), Red-headed merlin(Falco chicquera),ছোট কেস্ট্রেল / Lesser krestrel(Falco naumanni),পেরেগ্রিন শাহিন / Peregrine falcon(Falco peregrinus),উদয়ী টিকাশাহিন / Oriental hobby(Falco serverus), পাতি কেস্ট্রেল /Common krestrel(Falco tinnunculus), Brown-headed gull(Larus brunnicephalus),খুড়ুলে প্যাঁচা / Spotted owlet(Athene brama),খয়রা মেছোপ্যাঁচা / Brown fish owl(Ketupa zeylonensis), ইউরেশীয় নিমপ্যাঁচা /Eurasian scops owl(Otus scops),লক্ষ্মী প্যাঁচা / Barn owl(Tyto alba),ধূসর বক / Grey heron(Ardea cinerea),বেগুনি বক / Purple heron(Ardea purpurea),এশীয় শামখোল /Asian openbill(Anastomus oscitans),ছোট মদনটাক / Lesser Adjutant (Leptoptilos javanicus),নেউ পিপি / Pheasant-tailed jacana(Hydrophasianus chirugus), Darter(Anhinga rufa),ছোট ডুবুরি / Little grebe(Podiceps rufficollis),বাংলার রাঙাচ্যাগা / Greater painted snipe(Rostratula bengalensis),কালো মোটাহাঁটু / Black thick knee(Esacus magnirostris),কেন্টিশ জিরিয়া / Kentish plover(Charadrius alexandrinus),বড় ধুলজিরিয়া / Greater sandplover(Charadrius leschenaultii),ছোট ধুলজিরিয়া / Lesser sandplover (Charadrius mongulus),মেটে জিরিয়া / Grey plover(Pluvialis squatarola), হট টিটি /Red-wattled lapwing (Vanellus indicus),কাকরা জিরিয়া / Crab plover(Dromas Ardeola),পাকরা উল্টোঠুঁটি / Pied avocet(Recurvirostra avosetta),ডানলিন / Dunlin(Calidris alpina),গুলিন্দা বাটান / Curlew sandpiper(Calidris ferruginus), Little stint(Calidris minuta),ইউরেশীয় গুলিন্দা / Eurasian curlew(Numenius arquata), Whimbrel(Numenius phaeopus),পাতি সবুজপা / Common greenshank(Tringa nebularia),বিল বাটান / Marsh sandpiper (Tringa stagnatilis),পাতি লালপা / Common redshank(Tringa totanus)।
মাছেদের মধ্যে আছে, বাগদা /Tiger shrimp(Penaeus monodon), সাদা ইচা /White shrimp(Penaeus indicas), হরিনা-চিংড়ি /Brown shrimp(Metapenaeus monoceros), গোদা চিংড়ি /Rainbow shrimp(Parapenaeopsis spp.), গুড়া ইচা /Sengestid shrimp(Acetes indica), গলদা চিংড়ি /Giant fresh-water prawn(Macrobrachium rosenbergii), ইলিশ /Hilsha shad(Hilsha ilisha), চন্দনা /Sardines(Sardinella spp.) পাশা /Anchovy(Satipinna taty), পাঙ্গাস /Fatty catfish(Pangasius pangasius), সাগর-মাগুর /Estuarine catfish (Plotossus canius), ভেটকি /Seabass(Lates calcarifer), সুরি-মাছ /Rinnon fish(Trichiurus lepturus), ফুলি চান্দা /Silver pomfret(Pampas argenteus), রূপা পোয়া /Silver jewfish(Johnius arhentatus), চম্পা /Indian mackerel(Rastrilliger kanagurta)।
![]() |
জঙ্গলের নদীতে ইরাবতী |
![]() |
জঙ্গলে নোনাপানির কুমিড় |
![]() |
সুন্দরি সাপ (Mangrove snake) |
![]() |
গোলবাহার (Reticuleted python) বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা সাপ |
![]() |
জঙ্গলে চিতল হরিনের পাল |
![]() |
জঙ্গলে বন্য শুকর |
![]() |
জঙ্গলের বানর |
![]() |
জঙ্গলে উভচর চিংড়ি মাছ (Mudskiper) |
![]() |
জঙ্গলে লাল বন মোরগ (Red jungle fowl) |
মাছেদের মধ্যে আছে, বাগদা /Tiger shrimp(Penaeus monodon), সাদা ইচা /White shrimp(Penaeus indicas), হরিনা-চিংড়ি /Brown shrimp(Metapenaeus monoceros), গোদা চিংড়ি /Rainbow shrimp(Parapenaeopsis spp.), গুড়া ইচা /Sengestid shrimp(Acetes indica), গলদা চিংড়ি /Giant fresh-water prawn(Macrobrachium rosenbergii), ইলিশ /Hilsha shad(Hilsha ilisha), চন্দনা /Sardines(Sardinella spp.) পাশা /Anchovy(Satipinna taty), পাঙ্গাস /Fatty catfish(Pangasius pangasius), সাগর-মাগুর /Estuarine catfish (Plotossus canius), ভেটকি /Seabass(Lates calcarifer), সুরি-মাছ /Rinnon fish(Trichiurus lepturus), ফুলি চান্দা /Silver pomfret(Pampas argenteus), রূপা পোয়া /Silver jewfish(Johnius arhentatus), চম্পা /Indian mackerel(Rastrilliger kanagurta)।